অপরিকল্পিত নগরায়ণের পরিণতি
অপরিকল্পিত নগরায়ণের পরিণতি
নগর দুর্যোগ নতুন কিছু নয়, বরং যখন থেকে নগরের গোড়াপত্তন ঘটেছে তখন থেকেই আপদ ও দুর্যোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক এবং একবিংশ শতাব্দীতে এসে নগর দুর্যোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
প্রশ্ন হল, কেন এত বড় বড় বিপর্যয় নগরের সাধারণ বাসিন্দাদের অনিরাপদ ও মৃত্যু থেকে শুরু করে সম্পদ ধ্বংসের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এর উত্তর খুঁজতে হলে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল ও অনুন্নত সব দেশের নগরায়ণ প্রক্রিয়ার দিকে নজর দেয়া দরকার। অর্থাৎ এসব দেশের নগরায়ণ হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে এবং এটাকে অতি নগরায়ণ বলেও ব্যাখ্যা দেয়া হয়।
আমাদের রাজধানী ঢাকায় মাত্র ১৩৫৩ বর্গকিলোমিটার জায়গায় প্রায় দুই কোটি লোকের বসবাস, যেখানে ১৯৯৩ সালের আগে কোনো বিল্ডিং কোড ছিল না। এমনকি বিল্ডিং কোড প্রবর্তন হওয়ার দু’দশকের মধ্যে রাজউকের মাধ্যমে যেসব বিল্ডিংয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে সেগুলো বিল্ডিং কোড না মেনে নিজেদের ইচ্ছামতো নির্মাণ কাজ করেছে, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এফআর টাওয়ার।
যদিও ভূমিকম্প ঝুঁকিকে ঢাকা শহরের এক নম্বর ঝুঁকি বলা হয়; কিন্তু সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ সেটি হচ্ছে, বহুতলা এ ভবনগুলোয় স্থাপিত অফিসে অথবা আবাসিক এলাকায় অবস্থানকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে অগ্নিদুর্ঘটনা ও করণীয় সম্পর্কে কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞান এবং ন্যূনতম প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের সচেতন করা কিংবা কীভাবে জরুরি দুর্যোগ মোকাবেলা করা যায় সে বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে কোনো ধারণা ও ব্যবস্থা নেই।
সাধারণত বহুতল ভবনগুলোয় যে বিষয়গুলো জরুরি ও বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে সেগুলো হল- ভূমিকম্প ও আগুন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ভবনের সবাইকে মকড্রিল, সিমুলেশন এবং নির্গমন ব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যোগাযোগ স্থাপন করা, যাতে যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো জরুরি দুর্যোগ মোকাবেলা করার ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে বসবাসকারীরা সম্পৃক্ত হতে পারেন এবং মানসিকভাবে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকতে পারেন।
বাংলাদেশের নগরগুলোয় বহুতল ভবনের ব্যবস্থাপনায় আরও যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয় সেগুলো হল- স্মোক সেনসেটিভ ডিটেক্টর, ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম, স্মোকফিক্স/সেনসেটিভ ডোর, ভেন্টিলেশন, এক্সহাস্ট ফ্যান, অটো ফায়ার এক্সটিংগুইশার, ফায়ার ফাইটিং অ্যাপারেটাস, জরুরি হেল্পলাইন, ফায়ার সেফটি ক্লিয়ারেন্স (যেটি প্রতিটি ফ্লোরের দেয়ালে টানিয়ে দেয়া বাধ্যতামূলক হওয়া দরকার), ফায়ার ইন্সপেকশন, ফায়ার সিস্টেম মেইন্টেনেন্স, সেফটি ফায়ার ভলান্টিয়ার, ফায়ার প্রুফ স্টেয়ারস, ইমার্জেন্সি এলিভেটর, ফায়ার ইনসিডেন্ট রিমোটিং, ফায়ার স্টান্ডার্ড রুলস (সব ফ্লোরে টানিয়ে দিতে হবে) এবং জলাধার।
ঢাকা শহরে নির্মিত ভবনগুলোর কোনোটিই না ভূমিকম্প সহনীয় বা না আছে এর কোনো পরিকল্পিত ও অনুমোদিত নকশা। উল্লেখ্য, বিশ্বের সব পরিকল্পিত নগরীতে রয়েছে জোনভিত্তিক ভবন ও অন্যান্য অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধাসহ নানা ধরনের ইউটিলিটি সাপোর্ট সিস্টেম, যেটি মূলত টেকসই ও কম ঝুঁকিপূর্ণ।
কিন্তু ঢাকা শহরের ভবন নির্মাণে কোনো জোনিং নেই। যে কারণে এখানে রাজমিস্ত্রি, নন-ইঞ্জিনিয়ার, নন-আর্কিটেক্ট, নন-ডিজাইনার, এমনকি মালিক নিজেই সেল্ফ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ভবন, এমনকি বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন, যা শুধু হাস্যকর নয়, বরং ঝুঁকির মাত্রা কোনো স্কেলেও পরিমাণ করা সম্ভব নয়।
পাশাপাশি অপরিকল্পিত সরু লেনের সমাহার, যা দেখে মনে হয় এখানে নির্মাণের ক্ষেত্রে বাধা দেয়া বা মনিটর করার মতো কর্তৃপক্ষের উপস্থিতি নেই, নতুবা অদৃশ্য কোনো কারণে বাধা দেয়া হয়নি। যে কোনো দুর্যোগ ঘটে গেলে উদ্ধার কাজের জন্য যেমন দরকার ভারি ইকুইপমেন্ট, ফায়ার সার্ভিসের সব ধরনের সাপোর্ট, মেডিকেল সার্ভিসেস, ভলান্টিয়ারদের ভূমিকা, স্থানীয় সরকার ও সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব, ওয়াসা-ডেসার মতো সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত উদ্ধারকারী দল, ঢাকায় রয়েছে তার অনুপস্থিতি। যদিও মেয়রকে প্রধান করে নগর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি করা হয়েছে; কিন্তু সেই কমিটি এ পর্যন্ত কী কী কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে তা জানার সুযোগ হয়নি ঢাকাবাসীর।
নগরবাসীর অন্যতম একটি বড় ঝুঁকি হচ্ছে জরুরি দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলা ও নিরসনের ক্ষেত্রে সম্যক ও বাস্তব জ্ঞানের অভাব, যা দূর করার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক প্রচার, সচেতনতামূলক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ, উঠোন বৈঠক এবং মকড্রিল বা ডেমোনেস্ট্রেশন। এছাড়া এলাকাভিত্তিক জরুরি দুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য দরকার পর্যাপ্ত স্পেসসহ ইমার্জেন্সি রেসকিউ টিম, যারা র্যাব বা মোবাইল পুলিশ টিমের মতো বিভিন্ন এলাকা টহল দেবে।
Comments